Thursday |
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি সুস্থ দেহ আর সুন্দর মন নিয়ে ভালোভাবেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছো। আচ্ছা, তোমরা কি কেবল পাঠ্যপুস্তক পড়েই সময় কাটাও? জ্ঞানার্জনের জন্য কেবল পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভর করলে কিন্তু চলবে না। নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়া, রেডিও-টিভিতে খবর শোনা, ধর্মীয় বই বিশেষকরে কুরআন-হাদীস পড়লে অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘এই কুরআন বিশ্ববাসীর জন্যে উপদেশ বা জাগরণের মূল উৎস।’ মার্কিন চিন্তাবিদ ইরভিং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে বলেছেন-"এই গ্রন্থ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত সকল জনগণকে শান্তি ও সুখ-সমৃদ্ধির পবিত্র ছায়াতলে আশ্রয় দিয়েছে।"
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে ইরানের বিখ্যাত দার্শনিক আল্লামা তাবাতাবায়ী লিখেছেন, ‘জ্ঞানীদের জন্য কুরআন যেন এক অলৌকিক সম্পদ-ভাণ্ডার এবং আইন প্রণেতাদের জন্য এটি সবচেয়ে সামাজিক আইনের আঁধার। এই গ্রন্থে রয়েছে নীতিনির্ধারক বা রাজনীতিবিদদের জন্য সবচেয়ে নবীন ও নজিরবিহীন নীতি।‘
অন্যদিকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন পবিত্র কুরআন সম্পর্কে বলেছেন, কুরআন বীজগণিত, জ্যামিতি বা গণিতের বই নয়, বরং এ গ্রন্থে রয়েছে এমনসব বিধান যা মানুষকে সুপথ বা সত্যের পথে পরিচালিত করে, এই পথ হচ্ছে এমন পথ, যা নির্ধারণ করা ও যার সংজ্ঞা দেয়া বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের পক্ষেও সম্ভব নয়।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, কুরআন মজীদই একমাত্র গ্রন্থ যার পাঠক সংখ্যা অন্য যেকোন গ্রন্থের চেয়ে বেশী। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সকল আসমানী কিতাবের মধ্যে একমাত্র কুরআনই যেভাবে নাজিল হয়েছিল এখন ঠিক সেভাবেই রয়েছে। সত্যি বলতে কী, কুরআন হচ্ছে মানব জাতির কল্যাণ ও নাজাতের একমাত্র পাথেয়। মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালনা করবে তা কুরআন মজীদেই বলা হয়েছে। আর তাইতো ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অনেক ইসলাম বিরোধীও কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। অনেক অমুসলিম চিন্তাবিদ কুরআন নিয়ে গবেষণাও করেছেন। কুরআনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সম্পর্কে আজকের আসরে আমরা কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরব। আর সবশেষে থাকবে কুরআন নিয়ে একটি গান।
রাসূল যখন ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন, তখন কুরাইশ মুশরিকরা রাসূলের বিরুদ্ধে সব ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছিল। এমনকি নবীজির কাছে যাতে কেউ আসতে না পারে সেজন্যে তারা মানুষজনকে বাধা দিত। কিন্তু মুশরিকদের এতো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেও মানুষ কুরআনের মোহনীয় মাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে যেত। এরফলে মুশরিকদের মনে একটা প্রশ্ন জাগলো যে, এমন কী আছে কুরআনে যে, যে-ই শোনে সে-ই মুগ্ধ হয়ে যায়? মক্কার মুশরিকদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান এবং আখনাস। এরা দিনের বেলা ঠিকই অন্যদেরকে রাসূলের কাছে যেতে বাধা দিত আর রাতের বেলা নিজেরাই গোপনে গোপনে কুরআন তেলাওয়াত শোনার জন্যে রাসূলের ঘরের পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকত।
একরাতে এদের তিনজনই যার যার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনল। তেলাওয়াত শোনার পর যখন তারা বেরিয়ে এল, তখন সবার সাথে সবার দেখা হলো এবং সবার কাছেই সবার গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ল। ফলে পরস্পরকে তিরস্কার করতে লাগল এবং তারা শপথ করল যে, এই ঘরে আর কখনো আসবে না।
তারা মুখে একথা বললেও কুরআনের প্রতি আকর্ষণের কারণে তাদের শপথের কথা রাখতে পারল না। তাই পরের রাতেও তিনজনই রাসূলের নিজ মুখে আল্লাহর বাণী শোনার জন্যে বাইরে বেরিয়ে এল। পরপর
তিনদিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। কুরআনের প্রতি তাদের আকর্ষণ সৃষ্টি হলেও ঈর্ষাপরায়নতা ও গোঁড়ামির কারণেই তারা সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল।
ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক। একবার কুরাইশদের একটি দল ওয়ালিদকে নিয়ে রাসূলের কাছে গেল বিতর্ক করতে। কুরাইশরা অপেক্ষায় ছিল এই বুঝি ওয়ালিদ রাসূলকে পরাস্ত করে বসল। রাসূল কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। ওয়ালিদ প্রথম দিকে অহঙ্কারের সাথে আয়াত শুনছিল। কিন্তু পরক্ষণে দেখা গেল রাসূলের মুখে তেলাওয়াতের শব্দ যতই বৃদ্ধি পেতে লাগল, ওয়ালিদ ততোই শান্ত এবং আত্মসমর্পিত হতে শুরু করল। ওয়ালিদ বলল: "কী মধুর! এটা কিছুতেই মানুষের বানানো বক্তব্য হতে পারে না।"
আয়াতের মাধুর্য ওয়ালিদের ভেতর এতোটাই প্রভাব বিস্তার করল যে, সে পরিবর্তিত হয়ে গেল। মুশরিকরা তাকে ভয় দেখাল, সাবধান করে দিল। কিন্তু ওয়ালিদ বলল, "মুহাম্মাদের কাছ থেকে যেসব কথা আমি শুনেছি , সেসব কথা এতো আকর্ষণীয় যে অন্য কারো কথার সাথে তার তুলনা হয় না। তার বক্তব্যকে ঠিক কবিতাও বলা যায় না, আবার গদ্যও বলা যায় না, গদ্য-পদ্যের উর্ধ্বে তাঁর বক্তব্য গভীর অর্থপূর্ণ, মিষ্টি-মধুর, কল্যাণময় ও প্রভাব বিস্তারকারী। তাঁর বক্তব্য এতোই উচ্চমানের যে, কোনোকিছুই তারচেয়ে উন্নত হতে পারে না।"
বন্ধুরা, এবার আমরা আরেকজন জ্ঞানী ও বিজ্ঞ লোকের কথা বলব- যিনি রাসূলের কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শোনার সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করেন। ওই লোকটি ছিলেন আদ দাউস গোত্রের সরদার তুফাইল ইবনে আমর। তিনি একজন কবিও ছিলেন। একবার তিনি মক্কার আসার পর মক্কার সর্দাররা তাকে মুহাম্মদ (সা.) এর সাথে দেখা করতে নিষেধ করে দিল। তারা জানালো, মুহাম্মদের কথা মক্কায় ভীষণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। কুরাইশ নেতাদের কথামতো তুফাইল ইবনে আমর মহানবীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে লাগলেন। কখনও তিনি মহানবীর মুখোমুখি হলে চোখ বুঁজতেন এবং কান বন্ধ করতেন। ঘটনাক্রমে একদিন যখন মহানবী (সা.) কাবা ঘরে নামায পড়ছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত কুরআনের আয়াতগুলো তুফাইলের কানে প্রবেশ করল। মুহূর্তেই আয়াতগুলো তাঁর হৃদয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। নামায শেষে যখন নবীজী কাবাঘর থেকে বের হয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হলেন, তখন তুফাইল তার পিছু পিছু নবীজীর বাড়িতে গেলেন। বাড়ীতে পৌছার পর তিনি আবারো আয়াতগুলো তেলাওয়াত করার জন্য নবীজীর প্রতি অনুরোধ জানালেন। মহানবী কুরআনের আয়াতগুলো পুনরায় তেলাওয়াত করলেন। অভিভূত তুফাইল সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
বন্ধুরা, এবার আমরা জামাদ নামে ইয়েমেনের একজন জাদুকরের কথা বলব যিনি রাসূলের কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শোনার সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। জাদুকর জামাদ ইয়েমেন থেকে মক্কার আসার পর কুরাইশ নেতাদের বললেন, মুহাম্মদের ওপর যে দুষ্ট দেবতার আছর হয়েছে তা সে ছাড়িয়ে দেবে। কুরাইশ নেতারা এ কথা শুনে খুশী হলো। জামাদ মহানবী (সা.) এর কাছে গিয়ে হাজির হয়ে বলল, ‘আমি শুনেছি আপনার ওপর নাকি দুষ্ট দেবতার আছর করেছে, আমি তা ছাড়িয়ে দিতে চাই।’
মহানবী এ কথা শুনে কোনো রাগ না করে বললেন, ‘আপনার যা করার করবেন, তার আগে আমার কথা শুনুন।’ - একথা বলে নবীজী পবিত্র কুরআন থেকে কয়েকটি আয়াত পাঠ করলেন। আয়াতগুলো শুনে জামাদ অভিভূত হয়ে গেল এবং আয়াতগুলো আবারো পাঠ করার অনুরোধ করল। মহানবী আয়াতগুলো দ্বিতীয়বার যখন পাঠ করা শেষ করলেন তখন জামাদ চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমি বহু ভবিষ্যদ্বক্তা, জাদুকর ও কবির কথা শুনেছি কিন্তু আল্লাহ সাক্ষী এই কথাগুলোর কোনো তুলনা নেই।’ এরপর জামাদ বলল, হে মুহাম্মদ! আপনার হাত বাড়িয়ে দিন, আমি ইসলাম গ্রহণ করছি।
বন্ধুরা, কুরআনের আকর্ষণে কয়েকজন মুশরিকের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী শুনলে। এবার আমরা কুরআন শেখার গুরুত্ব ও কুরআনের প্রভাব সম্পর্কে কিছু কথা বলব। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “আল্লাহর ঘরে যারা কুরআন শেখার জন্যে সমবেত হয় এবং এ লক্ষ্যে নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনা করে, তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও শান্তির ধারা বর্ষিত হয়।“
রাসূলেখোদা আরও বলেছেন : "তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শেখে এবং অপরকে শেখায়।" তিনি এর গুরুত্ব বোঝাতে বলেছেন, তুমি যদি অন্তত একটি আয়াতও জানো, তা-ই অপরের কাছে পৌঁছে দাও এবং প্রচার করো।”
রাসূল (সা.) সবসময়ই কুরআনের আয়াতগুলোকে মুখস্থ করা এবং জনগণের সামনে সেগুলো তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতেন। ওহীর আয়াতগুলো শেখার ওপর তিনি ভীষণ গুরুত্ব দিতেন এবং খুব দ্রুতই সেগুলো আয়ত্ত করে ফেলতেন। রাসূলের ওপর যখন কুরআনের আয়াত নাযিল হতো, তখন অনেক সাহাবী স্বেচ্ছায় কিংবা রাসূলের নির্দেশে সেই আয়াতগুলোকে কাঠ, খেজুর পাতা, পাথর কিংবা চামড়ার ওপর লিখে রাখতেন। এভাবে আয়াতগুলোকে সংরক্ষণ করা হতো।
যে সমাজকে জাহেলিয়াতের গোঁড়ামি আর অজ্ঞতা পরিপূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল, কুরআনে কারীমের মাধ্যমে রাসূল (সা.) সেই সমাজে তৌহিদের বার্তা প্রচার করলেন। কুরআনের সূরাগুলো মানুষকে নোংরামি আর কদর্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখে মনুষ্যত্ব, এবং জীবনের সঠিক বোধ ও উপলব্ধি- এককথায় জীবনের সঠিক মাপকাঠির দিকে আহ্বান জানালো। একইভাবে কুরআনের আয়াতগুলো চমৎকার প্রকৃতি যেমন সূর্য ওঠা ভোর, তারাভরা রাতের আকাশ, ভূমি ও আকাশ সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় বা স্তর প্রভৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এইসব আয়াতের সাহিত্যিক গুণ যেমন অসাধারণ তেমনি এগুলোর জ্ঞানগত মূল্যও বিস্ময়কর।
রাসূলের মতো একজন নিষ্পাপ ও মহান ব্যক্তিত্বের মুখে যখন এইসব আয়াত উচ্চারিত হতো, তখন আয়াতের ঐশ্বর্য সবাইকে আন্দোলিত করত। কুরআনের আয়াতের বার্তা দিয়ে রাসূল জনগণের দৃষ্টি খুলে দিলেন।
কুরআন হলো চিন্তা-গবেষণার জন্যে অলৌকিকতাপূর্ণ একটি গ্রন্থ, সে কারণেই মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও বিচক্ষণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কুরআনের দর্শনীয় প্রভাব পড়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কুরআন একদিকে যেমন মানুষকে আল্লাহর পথ দেখিয়েছে, অপরদিকে মুসলমানদের উন্নতিও নিশ্চিত করেছে। কুরআনের আয়াতের আলো দিয়েই রাসূল তাঁর দাওয়াতী কাজ চালিয়েছেন এবং এভাবেই একটা বৃহৎ ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়।
রাসূলের পরেও কুরআনের আয়াতগুলো নিষ্প্রাণ অন্তরগুলোকে সুগন্ধি স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ বুলিয়েছিল। মানব উন্নয়ন তথা জ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে কুরআনের অজানা রহস্যগুলোও একের পর এক উন্মোচিত হয়েছে।