Thursday |
‘বল বীর / চির উন্নত মম শীর’- মন্ত্রে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহসী উচ্চারণে শোনালেন বিদ্রোহের বাণী। তিনি আর কেউ নন। আমাদের প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে সাম্যবাদ, নারীর মর্যাদা ও মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা প্রেম। যেহেতু একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে তার সমসাময়িক অবস্থা বা প্রেক্ষাপটের ওপর। কোনো সচেতন শিল্পী তার সময় ও সমাজকে কখনো অস্বীকার করতে পারেন না। কাজী নজরুল ইসলাম তার ব্যতিক্রম নন। তিনি দেশের এমন এক সঙ্কটময় মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছেন; যখন মুক্তি সংগ্রামের স্লোগান আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। ফলে এ আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাব পড়েছে তার কাব্যে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার নেশায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন উন্মাদ। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে হয়েছেন মহাবিদ্রোহী। কিন্তু তারপরও মানব মনের চিরন্তন প্রেমের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে তার কাব্যে। কখনো তার বিদ্রোহের মাঝে প্রেম; আবার কখনো প্রেমের মাঝে বিদ্রোহ। সবমিলিয়ে একাকার হয়ে যায় সাম্যবাদে। এসবই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়েছিল প্রিয়তমার মতো।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম স্বমহিমায় বাংলাসাহিত্যে চির ভাস্বর হয়ে আছেন। তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ঘুমভাঙার গান’, ‘ফণিমনসা’, ‘সর্বহারা’, ‘জিঞ্জির’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘সাম্যবাদী’ ইত্যাদি কাব্যের মাধ্যমে তিনি জাগরণের গান শুনিয়েছেন মানুষকে। জাতির বন্দিত্ব মোচনের জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল অকৃত্রিম। তিনি বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন:
‘লাথি মার ভাঙরে তালা,
যতসব বন্দীশালা,
আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা।’
তার এ বিদ্রোহ অনাসৃষ্টির জন্য নয়। পুরাতনকে ভেঙে নতুন করে গড়ার বিদ্রোহ। দেশ-জাতি-সমাজকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তার বিদ্রোহ ছিল শাসক, যাজক ও সমাজপতিদের বিরুদ্ধে। তার এ বিদ্রোহ নিরন্তর। যতদিন না এর কোনো প্রতিকার হবে। তাইতো তিনি বলেছেন:
‘মহাবিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত।
আমি সেই দিন হব শান্ত।'
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পর কবির এ বিদ্রোহ সমাপ্ত হয়ে যাবে। বাস্তবিক অর্থে মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এমন বিদ্রোহী হয়ে ওঠা যায়?
নিঃসন্দেহে কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই তিনি আজ সর্বত্র ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে সমাদৃত। বিদ্রোহী অভিধায় অভিসিক্ত হলেও কাজী নজরুল ইসলাম একজন খাঁটি প্রেমিক। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য কারাবরণ করলেও প্রেমের মহিমার ক্ষেত্রে আরো বেশি সমুজ্জ্বল তিনি। অন্তরে প্রেম না থাকলে কখনো এমন বিদ্রোহ আসে না। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’- এ যেন কবি নজরুলের অন্তরের কথা। এছাড়া নারীর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গানে ও কবিতায়। নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তিনি। নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিতে গিয়ে কবি বলেছেন:
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ কথা আমরা কখনো অস্বীকার করতে পারি না।
‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ কিংবা ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’- এ ধরনের গানে তার অপার্থিব প্রেমের উৎসরণ লক্ষ্য করা যায়। এ ক্ষেত্রে তাকে প্রেমিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অত্যুক্তি করা হবে না। বিদ্রোহী রূপের আড়ালে তার চিরায়ত কামনা-বাসনা-প্রেমকে ঢেকে রাখার সাধ্য আছে কার? কবি এও বলেছেন-
‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’
মূলত নারীর উৎসাহ-প্রেরণা ও প্রেমের মহিমা তাকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ জুগিয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তার প্রেম প্রকাশিত হয়েছে। নারী হৃদয়ের ব্যর্থতা, ক্ষোভ ও বাসনাকে কবি নিজের বিদ্রোহের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে যেমন বিদ্রোহী; অন্যদিকে আবার রোমান্টিক কবি। দীর্ঘাকৃতির ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যেও প্রেমের মহিমাকে তিনি উচ্চকিত করে তুলেছেন। কবির ‘মানুষ’, ‘সাম্যবাদী’ ও ‘আমার কৈফিয়ত’ প্রভৃতি কবিতায় বিদ্রোহ ফুটে উঠলেও সেখানে অত্যাচারিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, অসহায় মানুষের প্রতি ছিল তার সীমাহীন দরদ স্বার্থহীন ভালোবাসা। ‘সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রেমের নিবিড়তা, চিরন্তনতা এবং বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালার প্রকাশ দেখা যায়। সিন্ধুর অশান্ত রূপ কবিচিত্তের বিচ্ছেদ জ্বালা পথিকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। কবি বলেছেন:
‘এক জ্বালা, এক ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ আমি কাঁদি, কাঁদে মোর হিয়া।’
নজরুল ইসলামের কাব্যে প্রেম বা রোমান্টিসিজম সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন: “প্রকৃতির মাঝে আত্মভাবের বিস্তার এবং একই সাথে প্রকৃতির উপাদান সান্নিধ্যে অন্তর ভাবনার উন্মোচন রোমান্টিক কবির সহজাত বৈশিষ্ট্য। ‘চক্রবাক’ কাব্যে নজরুলের এই র